পুত্রহীন পিতার সম্পদে কন্যাদের অধিকারঃ
শুনা যাচ্ছে বর্তমান সরকার নারীদের প্রতি
ইনসাফের অজুহাত দেখিয়ে কুরআন ও হাদীছে নির্ধারিত মিরাছী আইন পরিবর্তন করে
মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদে ছেলের অবর্তমানে মেয়েদেরকে পূর্ণ সম্পদের
অধিকারী করতে যাচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা সম্পন্ন কতিপয়
চিন্তাবিদও দেশীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অজুহাত দেখিয়ে এবং তা
গ্রহণযোগ্য করে তোলার পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে কুরআনের অ
পরিবর্তনযোগ্য আইনকে পরিবর্তনের পক্ষেই সমর্থন দিচ্ছেন।
তাই সকল মুসলিম ভাই বোনদের জন্য সতর্কতা
স্বরূপ এই প্রবন্ধটি লিখলাম। কারণ এই বিষয়টি ইলমে ফারায়েজের সাথে সম্পৃক্ত
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অন্যান্য মাসআলার ন্যায় এখানে আলেমদের মাঝে
তেমন একটা মতভেদ নেই। কারণ ফারায়েজের মাসআলাগুলো সরাসরি কুরআন ও হাদীছ
দ্বারা নির্ধারিত। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। তাও আবার
বিজ্ঞ সাহাবীদের ইজতেহাদ দ্বারা বিষয়টি খোলাসা করে দেয়া হয়েছে। আমাদের
উচিত হবে কুরআনের সেই অলঙ্ঘনীয় বিধানকে মনে প্রাণে মেনে নেওয়া। কারণ
আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়ার মধ্যেই আমাদের জন্য উভয় জগতের কল্যাণ রয়েছে। সেই
সাথে আলেমদের উচিত ইলমে ফারায়েজের এই মাসআলাটি সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করা।
কারণ এ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরা যদি কথা বলে তাহলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়বে
এবং সমাজ থেকে ইলমে ফারায়েজের জ্ঞান বিলুপ্ত হবে। ইলমে ফারায়েজ শেখার প্রতি
উৎসাহের অংশ হিসেবে আমি সম্মানিত পাঠকদের সামনে এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি
পেশ করছি। এতে আমি মুসলিম উম্মাহর নিকট গ্রহণযোগ্য আলেমদের কয়েকটি ফতোয়াও
উল্লেখ করেছি। মূল কথা হচ্ছে কন্যাগণ কখনই মৃতের সমুদয় সম্পদের অধিকারী হতে
পারে না। যদিও তাদের সংখ্যা একাধিক হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, কতিপয়
গবেষক ও নামধারী ইসলামী চিন্তাবিদ সরকারের সর্বশেষ এই ইসলাম বিরোধী আইনটির
প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে গিয়ে নারীদের প্রতি এত বেশী মায়া ও দয়া দেখানোর
ব্যর্থ চেষ্টা করছেন যে, তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় আল্লাহর এই দুর্বল
সৃষ্টির প্রতি তারাই আল্লাহর চেয়ে অধিক দয়াবান হিসেবে প্রকাশিত হতে
চাচ্ছেন। আল্লাহ নারী ও পুরুষ উভয়ের সৃষ্টিকারী, রিজিক দাতা। কাকে কত সম্পদ
দিলে সে লাভবান হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা তিনিই অধিক অবগত আছেন। সুতরাং এ
ব্যাপারে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী হয়ে আমাদের জন্য আল্লাহর সেই কল্যাণকর
আইন ও বণ্টন ব্যবস্থায় হাত দেয়ার চেষ্টা করা বা আল্লাহর নির্ধারিত হক ও অংশ
থেকে কাউকে বঞ্চিত করা মারাত্মক অন্যায়।
মূলত: আমাদের সমাজের অধিকাংশ নাগরিকই
জালেম। তাই শাস্তি স্বরূপ তাদের উপর জালেম শাসক চাপিয়ে দেয়া হয়। যে সমস্ত
পিতা ছেলে ও মেয়ে উভয় প্রকার সন্তান রেখে যায় সে ক্ষেত্রে ভাইয়েরা তাদের
বোনদের উপর জুলুম করে থাকে এবং বোনদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয়। এটি
একটি বিরাট জুলুম ও অবিচার। অপর পক্ষে যে সমস্ত পিতাগণ শুধু কন্যা সন্তানের
পিতা তারা জীবিত থাকতেই কন্যাদের প্রতি অতি আবেগী ও দয়াবান হয়ে এই আশঙ্কায়
সমস্ত সম্পদ কন্যাদেরকেই লিখে দিয়ে যায় যে, মরার পরে ভাইয়েরা বা ভাতিজারা
কন্যাদের সম্পদে ভাগ বসাবে। এটিও একটি বিরাট অপরাধ ও আল্লাহর আইনে
হস্তক্ষেপের শামিল। আসলে আল্লাহর নির্ধারিত বিধান ও ফয়সালায় কারও প্রতি
জুলুম করা হয় নি। এখানে প্রত্যেক হকদারকে তার হক পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়া
হয়েছে। আল্লাহর বিধান মেনে নেয়ার মধ্যেই রয়েছে মুসলিমদের ইহপরকালীন কল্যাণ।
আসুন এ ব্যাপারে ইসলামে বর্ণিত ফয়সালা ও আলেমদের কয়েকটি সমাধানের প্রতি
দৃষ্টি দেই। এই সমাধানগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে মৃতের সম্পদ বণ্টনের
ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জিত হবে।
ইনশা-আল্লাহ।
প্রথম সমস্যা ও কুআনের সমাধান:
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি স্ত্রী, মাতা, দুই কন্যা এবং এক ভাই ও এক বোন রেখে মারা গেছে। এই মাসআলার সমাধান কি?
উত্তর: আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল, তাঁর পরিবার ও সাহাবীর উপর।
উক্ত মাসআলায় সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতি নিম্নরূপ:
للزوجة الثمن فرضا، لقوله تعالى: (فَإِنْ كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُمْ
স্ত্রীর অংশ যেহেতু নির্ধারিত তাই সে
পাবে, ১/৮। আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমাদের যদি সন্তান থাকে তাহলে স্ত্রী পাবে
তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদের এক অষ্টমাংশ ১/৮। (সূরা নিসাঃ ১২)
وللأم السدس فرضا أيضا، لقوله تعالى: (وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُوَلَدٌ
নির্ধারতি অংশ হিসেবে মাতা পাবে ১/৬। আল্লাহ তায়ালা বলেন: মৃতের যদি সন্তান থাকে তাহলে পিতা-মাতার প্রত্যেকেই পাবে ১/৬।
وللبنتين الثلثان فرضا لقوله تعالى: (فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ
দুই কন্যার অংশও যেহেতু কুরআনে
নির্ধারিত, তাই তারা উভয়ে মিলে পাবে ২/৩। আল্লাহ তায়ালা বলেন: কন্যাগণ যদি
দুইয়ের অধিক হয়, তাহলে তারা সকলে মিলে মৃতরে সাম্পদের ২/৩ পাবে। (সূরা
নিসাঃ ১১)।
والباقي للأخ والأخت الشقيقين تعصيبا
لقوله تعالى: (وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالاً وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ
مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ
আর যা বাকী থাকবে তা পাবে আসাবা হিসেবে
সহোদর ভাই ও বোন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: আর তারা যদি ভাই ও বোন হয় তাহলে একজন
পুরুষ দুইজন মহিলার সমান হিসেবে সম্পদ ভাগ হবে। (সূরা নিসাঃ ১৭৬)
মাসআলাটি বুঝতে নীচের ব্যাখ্যাটির প্রতি খেয়াল করুন:
মনে করি মৃত ব্যক্তি উপরোক্ত আত্মীয় ও ২৪
টাকা রেখে মারা গেছেন। এই ক্ষেত্রে এই চব্বিশ টাকা যদি আমরা কুরআনের আলোকে
ভাগ করি তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রী পায় ৩ টাকা + মাতা পায় ৪ টাকা + দুই
কন্যা মিলে পায় ১৬ টাকা + ভাই ও বোন মিলে পায় ১ টাকা = ২৪ টাকা। আল্লাহই
ভাল জানেন।
দ্বিতীয় সমস্যা ও সমাধান:
আমি এখানে পাঠকদের জন্য এ ব্যাপারে আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি সমাধান শেয়ার করছি।
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি তার স্ত্রী, দুই কন্যা,
এক সহোদর বোন এবং এক বৈমাত্রেয় বোন রেখে মারা গেছেন। এই ক্ষেত্রে মৃতের
সম্পদ ভাগ করার পদ্ধতি কি? বা প্রত্যেকের অংশ কত?
উত্তর: যেহেতু মৃতের সন্তান আছে, তাই স্ত্রী
পাবে মূল স¤পদের ১/৮। দুই কন্যা মিলে পাবে ২/৩। যা বাকী থাকবে, তা আসাবা
হিসেবে সহোদর বোন পাবে। কারণ তারা কন্যাদের সাথে আসাবায় পরিণত হয়েছে।
বৈমাত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে। এই বণ্টন তখনই প্রযোজ্য হবে যখন মৃতের আর কোন
ওয়ারিশ না থাকবে।
বণ্টনের ধরণ:
মনে করি উপরোক্ত মাসআলায় মৃত ব্যক্তির রেখে
যাওয়া স¤পদের পরমিাণ ২৪ টাকা। স্ত্রী পাবে ৩ টাকা + দুই কন্যার প্রত্যেকেই
পাবে ৮ টাকা + ৮ টাকা + সহোদর বোন পাবে ৫ টাকা = ২৪ টাকা। বৈমাত্রেয় বোন
বঞ্চিত হবে।
তৃতীয় সমস্যা ও সমাধান:
প্রশ্ন: একজন লোক তার মাতা, এক কন্যা ও তিন সহোদর ভাই রেখে মারা গিয়েছে। তার স¤পদ কিভাবে ভাগ হবে?
উত্তর: যে ব্যক্তি মা, এক কন্যা ও তিন ভাই
রেখে মারা যাবে, তার যদি আর কোন ওয়ারিশ না থাকে তাহলে মা তার নির্ধারিত ১/৬
পাবে। কারণ তার রয়েছে সন্তান ও একদল ভাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِzمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَد
মৃতের যদি সন্তান থাকে তাহলে পিতা-মাতার প্রত্যেকেই পাবে ১/৬। (সূরা নিসাঃ ১১)
কন্যা যেহেতু মাত্র একজন, সেই হিসেবে তার জন্য নির্ধারিত অংশ অর্ধেক ১/২। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ
আর কন্যা যদি মাত্র একজন হয় তাহলে সে পাবে ১/২। সূরা নিসাঃ ১১)
বাকী সম্পদ ভাইদের মাঝে আসাবা হিসাবে সমান হারে ভাগ হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
ألحقوا الفرائض بأهلها فما بقي فهو لأولى رجل ذكر- متفق عليه
তোমরা হকদারদের নিকট তাদের নির্ধারিত হক
পৌঁছিয়ে দাও। আর যা বাকী থাকবে, তা মৃত ব্যক্তির অধিক নিকটবর্তী পুরুষের
জন্য। (বুখারী ও মুসলিম)
এই মাসআলায় মূল সম্পদ ১৮ ভাগে ভাগ হবে।
মাতার জন্য ১/৬ বা ৩/১৮, কন্যার জন্য ১/২ বা ৯/১৮ এবং তিন ভাইয়ের
প্রত্যেকের জন্য আসাবা হিসেব ২/১৮ + ২/১৮ + ২/১৮ = মোট ১৮/১৮।
অতঃপর আমরা মুসলিম ভাইকে সাবধান করতে চাই
যে, মৃত ব্যক্তির রেখে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি খুবই মারাত্মক এবং অত্যন্ত
কঠিন। সুতরাং এতেই শেষ নয়। কোন মুফতীর নিকট পেশ কৃত প্রশ্নের উত্তরের উপরই
নির্ভর করেই শেষ সমাধান করা ঠিক হবে না; বরং শরঈ কোর্টের কাছে তা পেশ করতে
হবে। কোর্ট দেখবে ও তদন্ত করবে। সেখানে এমন ওয়ারিশ থাকতে পারে, যা
অনুসন্ধান করা ব্যতীত খুঁজে পওয়া যাবে না। আর সেখানে মৃত ব্যক্তির ওসীয়ত
থাকতে পারে, তার উপর মানুষের পাওনা থাকতে পারে এবং অন্যান্য হকও থাকতে
পারে, যা ওয়ারিছদের জানে নেই। আর এটি জানা কথা যে, সম্পদে ওয়ারিছদের হকের
আগে অন্যান্য হক পরিশোধ করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুতরাং শরঈ কোর্ট
বর্তমান থাকতে তাতে না গিয়েই সম্পদ ভাগ করা ঠিক নয়।
No comments:
Post a Comment