Wednesday, May 30, 2018

প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কঃ এক টুকরো মাংস ও প্রতারণার কাহিনি – উস্তাদ নুমান আলী খান


প্রেমও শারীরিক সম্পর্কঃ এক টুকরো মাংস ও প্রতারণার কাহিনি – উস্তাদ নুমান আলী খান

বোনের প্রশ্নঃ
আমাকে একটু হেল্প করবেন? আমি খুবই অসহায় ও বিষন্নতায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমি কান্নাটুকু পর্যন্ত থামাতে পারছি না। আমি ১৭ বছরের একজন বালিকা। আমি একটা ছেলের সাথে মেসেজে কথাবার্তা বলতাম, এভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার কারণে একটা সময়ে ঐ ছেলের সাথে ইমোশনালি আটকে যাই। কিন্তু এখন আমি খুবই অস্থির হয়ে পড়েছি, আমি তাওবা করছি এরপরে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর জন্য। আমি গত বছর তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম, তার সাথে বাজে জিনিসও (শারীরিক সম্পর্কসহ অন্যান্য) করেছিলাম। আমি জানি আমি খুব খারাপ হয়ে গেছি, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। আমি জানি এই পৃথিবীটা খুবই স্বল্প সময়ের, আমি চাই না জাহান্নামে যাই এই ক্ষণিকের পৃথিবীতে অবাধ্যতার কারণে। আমি জানি এই লোকের সাথে আমার ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু তবুও কেন আমি তাকে বারবার অনুভব করি? যদিও সে আমাকে তার আসল (মন্দ) চেয়ারাটাও দেখিয়েছে। এমনকি সে আমাকে এও বলেছে যে ‘আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না’। আমি এখন মনে করি ইসলামই কেবল আমাকে সুখের দরজাটা দেখিয়ে দিতে পারে। আমি প্র্যাক্টিজিং মুসলিমা না, আমি প্রচূর পাপও করেছি, আমার জন্য কি আর কোনো আশা অবশিষ্ট আছে? প্লিজ ভাই, আমাকে সহায়তা করুন।
 
উস্তাদ নুমান আলী খানঃ

ধন্যবাদ আপনাকে।
প্রথমত, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে ‘ফাহশাহ’ (নির্লজ্জতা, বেয়াহাপনা, লজ্জাহীনতা) কে একটি সর্বোচ্চ পাপ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রকৃতই একটা বড় ব্যাপার এটি। আমার দৃষ্টিতে আজকের যুগে পিতামাতার অবাধ্যতার পরেই এই কাজটি যুবক-যুবতীরা সর্বাধিক করে থাকে। এর শুরু হয়ে থাকে টেকনোলজি (প্রযুক্তি) দিয়ে – সেটা হতে পারে ফেইসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, মেইল এবং ইন্টার্নেটের পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি। এগুলো দিয়ে প্রথমে শুরু হয়ে এর বাস্তবিক রুপ ধারণ করে শারীরিক সম্পর্কের মতো বড় নির্লজ্জ ও নিকৃষ্ট কর্মে – আর এটি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

বোনের প্রশ্নটির দিকে আগে আসি, কোনো আশা আছে কি না এবং এরপরে আমরা এসব সম্পর্কের বিপদাপদ ও অন্যান্য ফল নিয়ে আলোচনা করবো।

এই বোনের জন্য আশা বাকী আছে কি? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা প্রত্যেক পাপীকেই বলেন আশা হারিও না, নিরশা হয়ো না। তিনি খুবই ইন্টারেস্টিং শব্দ ও বাক্য চয়নের মাধ্যমে বলছেন,

“হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ (আল্লাহর সীমারেখার বিরুদ্ধে এবং নিজেদের অপরাধের কারণে নিজেরাই ভোগান্তিতে পড়ে), তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি অতিব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [ সূরা জুমারঃ ৫৩]

তাওবাহর ব্যাপারে আল্লাহর এই মূলনীতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমি সূরা ফুরকানের একটা গুরুত্বপূর্ণ আয়াত নিয়ে কথা বলবো। সেটা হলো, আল্লাহ এমন এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করছেন যে কাউকে হত্যা করেছে অথবা জিনা (বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক) করেছে। আমরা এই আয়াত দিয়ে দেখবো বিশুদ্ধ তাওবাহ আসলেই কি জিনিস। আল্লাহ এই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন,

“তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সর্বদা সৎকাজ করতেই থাকে; আল্লাহ ওদের পাপগুলোকে পুণ্যে রূপান্তর করে দেবেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (২৫:৭০)

এখানে তিনটি জিনিস রয়েছে

(১) তারা তাওবাহ করে আল্লাহর কাছে ফিরে এসেছে।
(২) এভাবে সে নিজের ঈমানকে নবায়ন করেছে আল্লাহ আখিরাত ও অন্যান্য বিষয়ের প্রতি।
(৩) এরপর সে সর্বদা ভালো কাজ করতেই থাকে।
আল্লাহ এদের ব্যাপারেই ঐ আয়াতেই বলেছেন যে, এদের একটা বিশাল পাহাড় পরিমাণ পাপকেও আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া দিয়ে সম্পূর্ণ সাওয়াব ও সৎকাজে রুপান্তরিত করে দেবেন!! তিনি আপনার সমস্ত ময়লাকে ডায়মন্ডে পরিবর্তিত করে দেবেন কেবল যদি উক্ত তিনটি কাজ করেন। ঈমান নবায়নের বিষয়ে একটা কথা হলো, এটা কেন দরকার? কারণ হলো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

“একজন চোর যখন চুরি করে তখন সে তার ঈমানদার থাকে না”। এভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“একজন জেনাকারী যখন জেনার কাজ করে সে তখন আর মুমিন থাকে না”।

কারণ জেনাকারীর ঈমান থাকে না বলেই সে লজ্জাহীন (লজ্জা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা পাপ থেকে বিরত রাখে) হয়ে খারাপ কাজে পতিত হয়। আর একারণেই তাকে পূনরায় ঈমান আনতে হয়। এটা রাসূলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। আল্লাহ ঈমানের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন তার দিকে ফিরে আসো, এরপর ঈমান নবায়ন করো।

এসব জিনা-অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ও প্রেম বিষয়ে প্রথম কথা হলো, কোনো কথা না বলে একদম স্টপ, ইমেইল, ফেইসবুক, টুইটার এসব বন্ধ করুন এসব, যেন কোনো ধরণের যোগাযোগ না হয়। আল্লাহর বিরপরীতে কারো কোনো কথা শোনার দরকার নেই, আল্লাহর অবাধ্যতায় কোনো ওয়াদা নেই, প্রমিজ নেই, পাপ থেকে বিরত হোন আগে, স্বল্প দুনিয়ার বিপরীতে অনন্ত আখিরাতের ঘরের সৌন্দর্য ও নেয়ামাতকে নষ্ট করাটা পুরো বোকামি, এর মাঝে একটু বুদ্ধিমত্তারও পরিচয় নেই (সমাধান বিষয়ে ১ম ও ২য় পর্বে আরো কিছু বিষয় উঠে এসেছে, সে পর্বগুলো অবশ্যই দেখুন)। আপনি যদি মনে করেন এক থাকার কারণে এসবের প্রভাব ফেলবে, তাহলে একাকী অবস্থান করা বন্ধ করুন, ভালো মানুষদের সঙ্গী হোন, মসজিদে অবস্থান করুন, আল্লাহর ইবাদাহ করুন, আপনার পিতামাতার খেদমত করুন, অন্যান্য ভালো বান্ধবীদের সাথে চলাফেরা করুন। এসবের মাঝে ব্যস্ততা আপনার পাপ করার সুযোগের সময়কে খেয়ে ফেলবে, আপনি পাপ করার সময় পাবেন না ভালো কাজে যুক্ত থাকার কারণে। আগে সত্যিকার এবং নিশ্চিতরূপে তাওবাহ করুন, এসব পাপ শক্তভাবে বন্ধ করুন।
অনেকেই আছে এসবের প্রতি প্রবলভাবে যুক্ত, যুক্ত থাকা অপছন্দও করে, নিজেদেরকে সেজন্য ঘৃণা করে আবার যুক্তও থাকে। যেমন ড্রাক এডিক্টরা ঐসব মাদককে ঘৃণা করে কিন্তু তবুও নেয় আর একারণে তারা নিজেদেরকে আরো ঘৃণা করতে থাকে। সুতরাং এরূপ অবস্থায় সর্বাধিক ফলপ্রসূ কাজ হলো আগে এসব পথ থেকে ফিরে আসতে হবে, বন্ধ করতে হবে পূর্ণরূপে। যে সময়, বন্ধু-বান্ধব এবং সুযোগ এসবের প্রতি আপনাকে নিয়ে যায় সেগুলোর পথগুলো বন্ধ করুন, সম্পূর্ণরুপে। এটা হলো প্রথম কথা।

এখন এই বোন যে ছেলেটির সাথে এভাবে জড়িয়ে গেছে, এর কারণ হলো মেয়েটি ইমোশনালি (আবেগে) জড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ মেয়েদেরকে আবেগের দিক থেকে অনেক বড় করে সৃষ্টি করেছে। এই আবেগকে ভালো পথে পরিচালিত করলে সেটা হয় শক্তিশালী (স্বামী, সন্তান, পিতামাতার প্রতি) জিনিস আর মন্দ পথে পরিচালিত করলে এটাই হয় ধ্বংসের কারণ (অবৈধ সম্পর্কে)। এভাবে ছেলেটি মেয়েটি ইমোশনালি আটকাতে চায়, এজন্য সে যত ধরণের আপাত সৌন্দর্যময় কথা আছে বলে, মিষ্টি যত কথা আছে বলে মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলতে চায় (১ম পর্বে আরো বিস্তারিত আছে এসব ফাঁদ বিষয়ে)। এসব কথা ছেলেটির কোনো উদ্দেশ্য না, ছেলেটির উদ্দেশ্য কেবল তার মনের খায়েশ মেটানো – একটাই উদ্দেশ্য। আপনি ইমোশনালি ঘায়েল মানে আপনি দূর্বল এবং ছেলেটি শিকারীর ভূমিকায় হামলার জন্য প্রস্তুত আর হামলার পর আপনি অক্ষত থাকবেন না, যন্ত্রনা ও অসুস্থতার শুরু কেবল। এভাবে ছেলেটির এজেন্ডা বাস্তবায়নের পর ছেলেটির কাছে আপনি এক টুকরো ব্যবহৃত মাংসের খন্ড ব্যতীত আর কিছুই না। দূর হ আমার থেকে, আমি তোকে আর ভালোবাসি না, অন্য কাউরে বিয়ে কর ইত্যাদি। অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছেলেদের সাইকোলজি এটাই।

আপনি এই সম্পর্কে আবেগে জড়িয়ে পড়েছেন, ছেলেটিও তার আসল চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে, এখন সমাধান হলো আপনি তার থেকে পূর্ণরূপে ফিরে আসুন, বন্ধ করুন পাপের খেলা। তাওবাহ করুন পূর্ণরূপে, আপনার দ্বীন শিখতে শুরু করুন, আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন হোন, ভালো কাজে সময় ব্যয় করুন।

আমি জানি আপনি অনেক কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু এই কান্নাকাটি ঐ ছেলের জন্য না করে আল্লাহর কাছে তাওবাহর জন্য করুন। ঐ ছেলের জন্য আপনার কান্না কোনো কাজে দেবে না, আল্লাহর জন্য, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে বিশুদ্ধ তাওবাহ করুন। আল্লাহ সর্বাধিক ভালোবাসেন ঐ ব্যক্তিকে যে তাওবাহ করে তার জন্য চোখের অশ্রু ফেলে, এই কান্নায় ভেজা চোখ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, বান্দাটি অধিক ভালোবাসার পাত্র।

No comments:

Post a Comment